এতক্ষণে মতিবাবুর সহধর্মিণীর মনে পড়লো--ঠাকুরমহাশয় মাংস ফেলে দেওয়ার কথা যে বলেছিলেন তা পালন করা হয়নি এখনও। মাংসের গামলা নামাতে গিয়ে তিনি অনুচ্চ-স্বরে একটু চিৎকার করে উঠলেন। মাংসের গামলার পাশেই একটি বিড়াল মরে পড়ে আছে, মাংসের টুকরোটি তার মুখের পাশে পড়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা সহজ যে ঐ মাংসের টুকরো মুখে দিতেই বিড়ালটি বিষক্রিয়ায় মৃত হয়েছে। ভয়ে তার তালু পর্য্যন্ত শুকিয়ে গেল। এই মাংসের একটু তো ঠাকুরমহাশয় গ্রহন করেছিলেন।ভয়ার্তকন্ঠে তিনি কাজের লোকটিকে বললেন ওঘর থেকে মতিবাবুকে একটু ডেকে আনার জন্য।মতিবাবু দেখলেন--শুনলেন। বিকল তার হৃদয়--বিবশ হল তার সারা শরীর। আর দাঁড়াতে পারলেন না, বসে পড়লেন রান্নাঘরেই। কাঁদতে কাঁদতেই স্ত্রীকে বললেন, তুমি আজ কী সর্বনাশ করলে তা তো তুমি বুঝছো না। মতিবাবুর সহধর্মিণীও কাঁদছেন অঝোরে আর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে "ঠাকুর! ঠাকুর!!" কাজের লোকটি গামলার সব মাংস নীচে ফেলে দিয়ে এলো। আর একটি ছোট ব্যাগে করে ফেলে দিয়ে এল মৃত বিড়ালটিকে হিদারাম ব্যানার্জী লেনের এক ডাস্টবিনে। মতিবাবু চোখ মুছে ঠাকুরঘরে গিয়ে বসলেন, ক্ষণে ক্ষণে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হচ্ছিল ঠাকুরমহাশয়ের মুখের উপর। কাজের লোক খাওয়া-দাওয়া করলো। মতিবাবুর সহধর্মিণীর আহারে আর রুচি ছিল না। তিনি বার বার ঠাকুরমহাশয়ের ঘরের কাছে যাচ্ছেন আর দূর থেকে দেখছেন শুষ্ক মুখে ঠাকুরমহাশয়কে।
অতিথিরা ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করে মতিবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিলেন রাত ন'টা নাগাদ। সদর দরজা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে গেলেন মতিবাবু। ফিরে এসে দেখেন তার সহধর্মিণী আকুল হয়ে ঠাকুরের চরণ ধরে অঝোরে কাঁদছেন। আর ঠাকুরমহাশয় বলছেন, "কানছেন ক্যান, কানছেন ক্যান, --আমার কিছু হইব না--সামান্য কিছু কষ্ট হইতে পারে।" বিমর্ষমুখে মতিবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠাকুরমহাশয় আবার মতিবাবুর স্ত্রীকে বললেন, "সারাদিন তো কিছু মুখে দেন নাই--যান কিছু খান--কিছু খান গিয়া।"
কিছু পরে ঠাকুরমহাশয় গেলেন শৌচাগারে। ফিরে এলেন, আবার গেলেন শৌচাগারে। তিন-চারবার যাওয়ার পরে ব্যাকুল হয়ে মতিবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি বারবার শৌচাগারে যাচ্ছেন কেন? আপনার কি পেট খারাপ হয়েছে? উত্তরে ঠাকুরমহাশয় জানালেন, বিষ না বাইর কইরা উপায় কী মতিবাবু? মতিবাবুকে পাঞ্জাবী পড়তে দেখে ঠাকুরমহাশয় জানতে চাইলেন, এত রাত্রিতে তিনি আবার কোথায় যাচ্ছেন।মতিবাবু ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছেন জেনে ঠাকুরমহাশয় জানালেন যে এখন যদি মতিবাবু ডাক্তার ডাকতে যান তা হলে তিনিও এ বাড়ি থেকে এখনই বেরিয়ে যাবেন। মর্মে মর্মে অনুভব করছিলেন তাদের অপরাধের জন্যই ঠাকুর এই ক্লেশ ভোগ করছেন। সেই ক্লেশভার সামান্য লঘু করার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হল তার এই ভেবে, ঠাকুরমহাশয় এই অসুস্থতার মধ্যে, দুর্বল দেহে, এত রাত্রে যদি বেরিয়ে পড়েন তা হলে চরম বিপর্যয়কে কি আরও টেনে আনা হবে না! ঠাকুরমহাশয় আবার শৌচাগারে গেলেন।এইভাবে চলল রাত্র প্রায় তিনটা পর্য্যন্ত। অসহায়, নিরুপায় হয়ে মতিবাবু শুধু প্রতিবারই শৌচাগারে এক ঘটি জল রেখে আসছেন আর মাঝে মাঝে ঠাকুরমহাশয় কাতরকন্ঠে বন্দ্যোপাধ্যায় দম্পতিকে অনুরোধ করছেন তারা যেন এবার গিয়ে তাদের বিছানায় কিছুক্ষন বিশ্রাম করেন। কিন্তু সে কথায় কেউ কান দিলেন না।বিষন্ন-মলিন মুখে তারা ঠাকুরের সামনেই বসে রইলেন। এবার ঠাকুরমহাশয় শৌচাগার থেকে এসে বললেন, "আর বিষ কিছু পেটে নাই--সব পরিষ্কার হইয়া গেছে।আপনারা এবার শোন গিয়া।" কিন্তু এবারও ঠাকুরের কথা শুনলেন না তারা দুইজন।
পাখীর কলরব প্রভাতের সূচনা ঘোষণা করলো। মুখ-চোখ ধুয়ে বন্দ্যোপাধ্যায় দম্পতি এসে বসলেন আবার ঠাকুরমহাশয়ের কাছে। ঠাকুরমহাশয় করুণকন্ঠে আবেদন করছিলেন যে তাঁর জন্য তারা আর কত কষ্টই না করবেন। তিনি তো তাদের কোন ভালই করতে পারেন নাই।তাঁর জন্য তারা দুঃখই শুধু পান, কেবলই দুঃখ পান।
গতকাল দশটার পরে যে দোকান ছেড়ে এসেছেন তারপরে আর তিনি দোকানে যাননি। সেইজন্য দোকান থেকে এক কর্মচারী এসেছে মতিবাবু কেমন আছেন তা জানতে। মিনিট কয়েক আগে ঠাকুরমহাশয় একটু শায়িত হয়েছিলেন। দোকানের কর্মচারীটিকে দেখেই ঠাকুরমহাশয় উঠে বসলেন, বললেন, মায়ের তো কাল সারা দিনরাত্রে কিছু খাওয়া হয় নাই। মতিবাবুও রাত্রে কিছু খান নাই। আপনে আইছেন খুব ভাল হইছে। আপনে দোকান থেইকা কিছু গরম লুচি, তরকারি ও মিষ্টি নিয়ে আসেন গিয়া। কর্মচারিটি তৎক্ষণাৎ চলে গেল এবং আধ ঘন্টা পরে খাবার নিয়ে এল।ঠাকুরমহাশয়ের অনুরোধে ওরা দু'জনে ঠাকুরের সামনে বসেই জলযোগ করলেন। ঠাকুরমহাশয়ের জন্য আর বিন্দুমাত্রও ভয়ের বা আশঙ্কার কারণ নেই এই অভয়বাণী পেয়েই মতিবাবু দোকানে চলে গেলেন। মতিবাবুর সহধর্মিণী পুনরায় লুন্ঠিতা হয়ে পড়লেন ঠাকুরমহাশয়ের পাদপদ্মে। ঠাকুরমহাশয় তাকে বললেন, "দ্যাখলেন না মা, সামান্য একটু খাওয়ানের বাসনার জন্য আপনে ও মতিবাবু কাল সারা রাত্রি কী কষ্টেই কাটালেন--খাওয়া হইল না--না হইল ঘুম। শুধু যন্ত্রণা, শুধু যন্ত্রণাই ভোগ পাইলেন। তার কারণ একটু বাসনা! যত বাসনা তত কষ্ট, তত বেদনা। বাসনা করবেন না মা। বাসনাই দুঃখ টাইনা আনে--বাসনাই বন্ধন।"
জয় রাম। জয় গোবিন্দ।।
প্রচারে কৈবল্যধাম।।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন