জয় রাম জয় গোবিন্দ "১৯২৯ সালের ঘটনা... এক মহত্প্রাণ সন্তের অপরিসীম দয়া ও ত্যাগের অনন্য কাহিনি..."
প্রচণ্ড শীতেও অন্যের কষ্ট দূর করাই ছিল ঠাকুরমহাশয়ের ব্রত। যখন তাঁকে উপহার দেওয়া হলো দামি ওভারকোট ও কাশ্মিরি শাল, তখন তিনি কী করলেন? কীভাবে এই শীতবস্ত্র পৌঁছে গেল এক দুঃস্থ আশ্রিতের ঘরে? জানতে হলে দেখুন সম্পূর্ণ ভিডিও..
-ঃস্বর্গীয় ডাঃ জে.এম.দাশগুপ্ত ও তার স্বর্গীয়া স্ত্রী কর্ত্তৃক ঠাকুরকে ওভারকোট ও শাল প্রদান ঃ-
ঠাকুরমহাশয় শিলং যাবেন। এই শীতকালে শিলং বাস তাঁহার নিতান্ত ক্লেশকর হবে এই বিবেচনা করে আশ্রিতবর্গের মধ্যে অনেকেই তাঁহাকে প্রতিনিবৃত্ত করার জন্য বারংবার অনুরোধ ও উপরোধ করেছেন।কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয় নি। ঠাকুরমহাশয় অটল। শিলং থেকে তাঁহাকে যখন তাঁহার আশ্রিতবর্গ আহবান জানিয়েছেন, তাতে সাড়া না দিয়ে শীতের অজুহাতে শিলংবাসীদের তিনি কি নিরাশ করতে পারেন? গ্রীষ্মের জন্য অপেক্ষা করে তাদের
প্রতীক্ষা দীর্ঘায়িত করতে চাননি ঠাকুরমহাশয়।
সেটা ১৯২৯ সালের ঘটনা। ঠাকুরমহাশয় তখন ছিলেন ৩১ নং টালিগঞ্জ রোডে।যেদিন শিলং যাত্রা করবেন সেদিন সকাল থেকেই ঠাকুরমহাশয়ের কাছে বহু আশ্রিতের সমাগম হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে এলেন অবিভক্ত বাংলার ভূতপূর্ব কংগ্রেস সভাপতি ও কলকাতার সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক স্বর্গীয় ডাক্তার যতীন্দ্রমোহন দাশগুপ্ত ও তার সহধর্মিণী।
ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করে স্বামী-স্ত্রী করজোড়ে বললেন, "বাবা,শিলং যাওয়া যখন আপনার স্থিরই তখন এই সামান্য একটু শীতবস্ত্র এনেছি, তা গায়ে দিলে শিলং-এর শীত কিছুটা কম বোধ হবে।" ডাক্তার যতীন্দ্রমোহন ভিনিসিয়ান সার্জের তৈরী ওভারকোটটি ঠাকুরমহাশয়কে গায়ে দিতে বললেন। ঠাকুরমহাশয় সঙ্গে সঙ্গে সেটা গায়ে দিলেন।উপস্থিত দু'একজন সমস্বরে বলে উঠলেন যে চমৎকার ফিট করেছেন। তারপর ডাক্তার যতীন্দ্রমোহন একটি সুদৃশ্য অতি মূল্যবান কাশ্মিরী শাল দিয়ে ঠাকুরমহাশয়ের অঙ্গ আবৃত্ত করে পুনরায় প্রণাম করলেন।
উপস্থিত সকলের মুখই আনন্দে উজ্জ্বল এই দু'টি শীতবস্ত্রে শিলং-এর শীত ঠাকুরমহাশয় নিশ্চিত কম বোধ করবেন। ওভারকোট ও কাশ্মিরী শাল কিছুক্ষণ অঙ্গে ধারণ করে 'উঃ, কী গরম' বলে দু'টোই তিনি আস্তে আস্তে অঙ্গ থেকে নামিয়ে তাঁহার শয্যার একপাশে রাখলেন। পূর্বে যা অঙ্গে ছিল সেই খদ্দরের চাদরখানাতেই তিনি তাঁহার দেহ আবৃত করে উপস্থিত সকলের সঙ্গে পুনরায় কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করলেন। ক্ষণকাল পরে জনৈক আশ্রিত এসে ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করে মাথা তুলতেই ঠাকুরমহাশয় তার হাতে তুলে দিলেন ঐ ওভারকোটটি এবং বললেন, "এটা গায়ে দিয়ে দেখুন তো আপনার ঠিক হয় কিনা।" ভদ্রলোক ইতস্ততঃ করছিলেন। এত মূল্যবান ওভারকোট তার মত দুঃস্থ লোক কী করে গায়ে তুলবেন। ঠাকুরমহাশয়ের আদেশই বা কেমন করে উপেক্ষা করেন।ঠাকুরমহাশয় পুনরায় বললেন, "গায়ে দিলেন না? শিগগির দেন"।অনেকটা নিরুপায় হয়েই তিনি কোটটি গায়ে দিলেন। আনন্দ-উজ্জ্বল মুখে ঠাকুরমহাশয় বলে উঠলেন, "এতো আপনার গায়ে ঠিক মানানসই হইছে। এটা আপনার জন্যই কেনা।আপনি এখন আসেন গিয়া। শিলং থেকে ফিরলে আবার দেখা হইব,আর বিলম্ব করবেন না, আপনি এখন চইলা যান।" অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকটা নিরুপায় হয়েই ভদ্রলোক চলে গেলেন।
সারা ঘরখানা থম থম করছে।ঠাকুরমহাশয় কিছু বলছেন না, উপস্থিত সকলেই নির্বাক,এমন সময় এসে প্রণাম করলেন আর একজন আশ্রিত। বালিশের পাশে রাখা মূল্যবান কাশ্মিরী শালটি ঠাকুরমহাশয় তাকে গায়ে দিতে বললেন। ভদ্রলোকের গায়ে ছিল একখানা নীলাভ জীর্ণ আলোয়ান। তিনি তা দেখিয়ে ঠাকুরমহাশয়কে বললেন, "আমার গায়ে তো আলোয়ান রয়েছে, আমাকে আবার কেন এত দামী শাল গায়ে দিতে বলছেন? আমি কি এত দামী শাল গায়ে দেবার মত মানুষ? ঠাকুরমহাশয়ের কন্ঠে একটা বজ্র লুকায়িত থাকত।দু'এক সময় সে স্বর বাহির হলে তা উপেক্ষা করার শক্তি কাহারও থাকত না।শাল গায়ে দিতে ঐ ভদ্রলোকের আপত্তি দেখে ঠাকুরমহাশয়ের বজ্র কন্ঠস্বর বেরিয়ে এলো--" উপযুক্ত কী অনুপযুক্ত, সে বিচার আপনার নয়।আপনি আগে গায়ে দেন।" নিতান্ত কাঁচুমাচু হয়ে ভদ্রলোক শালখানি নিজের গায়ে দিলেন এবং অপরাধীর মত অধোবদনে বসে রইলেন। ঠাকুরমহাশয় তখন বললেন, "আপনার তো তবু একখান আলোয়ান গায়ে আছে,আমার মায়ের তো তাও নাই।এখন যখন দু'খান হইল,তখন একখান মায়েরে দেন,একখান আপনি ব্যবহার করেন দিয়া"।যাকে ওভারকোটটি দিয়েছিলেন তাকে যেমন তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন ঠাকুরমহাশয়,শাল গায়ে দিয়ে যিনি বসেছিলেন তাকেও ঠাকুরমহাশয় বললেন, "আপনি বসে ক্যান? শিগগির বাড়ী যান।মায়ের গায়ে যত শীঘ্র শীতবস্ত্র দিতে পারবেন ততই মঙ্গল।" দ্বিরুক্তি না করে শাল গায়ে দিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন।
ডাক্তার যতীন্দ্রমোহন ও তার সহধর্মিণীর চারিটি চক্ষু জলপূর্ণ। ঠাকুরমহাশয় নিশ্চল পাষাণের মত বসে আছেন।করজোড়ে ডাক্তার যতীন্দ্রমোহন বললেন, ''বাবা শীতবস্ত্র সবই আপনি দান করে দিলেন,আমার তো কিছু নেই। আর কিছুক্ষণ বাদেই আপনি শিলং যাত্রা করছেন। আবার কিনে দেওয়ার তো সময় নেই। কিন্তু শিলং-এর প্রচন্ড শীতে যে বড্ড কষ্ট পাবেন "।
গায়ের খদ্দরের চাদরখানা খুলে আবার ভাল করে জড়িয়ে নিলেন ঠাকুরমহাশয়। বললেন, "এতেই সব শীত কাটব।আপনারা ভয় পাইবেন না।অনেকের তো খদ্দরের চাদরও এই শীতে জোটে না। তাদের কি শীত কাটে না? আপনাদের স্নেহেই আমার গায়ে এই চাদর।"
সহধর্মিণীসহ যতীন্দ্রমোহন দাশগুপ্ত নির্বাক।আর,উপস্থিত আশ্রিতবর্গ সম্পূর্ণ হতবাক। শুধু দেয়ালে বিলম্বিত বড় ঘড়িটির টিক টিক শব্দ শোনা যাচ্ছিল, ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে।
জয় রাম জয় গোবিন্দ
এমন মহানুভবতা, এমন ত্যাগ আজও আমাদের হৃদয়ে আলো ছড়ায়... জয় রাম, জয় গোবিন্দ!"
ঠাকুরমহাশয়ের এই দৃষ্টান্ত আমাদের শেখায়— প্রকৃত দান হলো যেখানে প্রয়োজন, সেখানে প্রদান। আমাদের চারপাশে অনেকেই আছেন, যারা শীতবস্ত্রের অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। আসুন, আমরাও তাদের পাশে দাঁড়াই।"
আপনি যদি এই কাহিনি থেকে অনুপ্রাণিত হন, তাহলে আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং ঠাকুরের মহিমা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন