সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

 

জয় রাম,
‘শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথ’ -পট নির্মাণের ইতিহাস,,
শ্রীশ্রীরামঠাকুরের আশ্রিত পরমভক্ত শ্রীযুক্ত মনমোহন পাইন মহাশয়। পেশায় তিনি ছিলেন একজন ফটোগ্রাফার। ঢাকা শহরে তাঁহার ছোট একটি দোকান ছিল। ফটোতোলার কাজ করিয়া পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা কোন প্রকারে অতি দরিদ্রতার সহিত নির্ব্বাহ হইত। শ্রীশ্রীরামঠাকুরের প্রতি ছিল তাঁহার অগাধ বিশ্বাস এবং ভক্তি। কোনরূপ উচ্চাকাঙ্খা বা প্রার্থনা ছিল না তাঁহার। শ্রীশ্রীরামঠাকুরের প্রতি মনমোহনদার গভীর অনুরাগ সদানন্দবাবুকে আকর্ষণ করিয়াছিল সহজেই। অন্যদিকে এত অল্প সময়ে গুরুর প্রতি সদানন্দের প্রগাঢ় ভক্তি শ্রদ্ধা, আকৃষ্ট করিয়াছিল ফটোগ্রাফার মনমোহনদাকে। স্নেহ ভালবাসার জোরে একে অন্যকে আপন করিয়া লইয়াছিলেন। বয়সের পার্থক্য বাধা হয় নাই। কখনও মনমোহনদার সংস্পর্শে আসিলে সদানন্দদাদা তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে থাকিতেই আনন্দ বোধ করিতেন।
মনমোহনদার প্রাণের ইচ্ছা শ্রীশ্রীরামঠাকুরের কয়েকটি ছবি তোলেন। কিন্তু স্বল্পভাষী লাজুক প্রকৃতির মানুষ, মনমোহনদা ঠাকুর মহাশয়কে বলিতে সাহস পাইতেছিলেন না। তাঁহার অন্তরের ওই ইচ্ছার কথা সদানন্দদাদাকেও বলিলেন। অবশেষে তাঁহার আন্তরিক বাসনা শ্রীশ্রীঠাকুর পূর্ণ করিলেন। ঢাকা শহরের গেন্ডারিয়াতে কোন এক ভক্তগৃহে শ্রীশ্রীরামঠাকুরের শুভাগমন হইল। সদানন্দদাদাকে সঙ্গে লইয়া মনমোহনদা অতিশয় কাতর হইয়া করজোড়ে ঠাকুর মহাশয়ের নিকট ছবি তোলার প্রার্থনা করিলেন। ঠাকুর মহাশয় পরের দিন তাঁহাকে আসিতে বলিলেন।
ছবি তোলার যন্ত্রপাতি বর্ত্তমানের ন্যায়, সেই সময়ে এত উন্নত ছিলনা। তাহা ছাড়া তখনকার অপেক্ষাকৃত উন্নত কারিগরির যন্ত্রাদি সংগ্রহ করা দরিদ্র মনমোহন পাইন মহাশয়ের সামর্থ্য তেমন ছিল না। তিন পায়া বিশিষ্ট একটি বস্তুর উপর ছবি তোলা বাক্সটি রাখিয়া ছবি তোলার কাজ সারিতেন তিনি। পরের দিন প্রত্যূষে পাইন মহাশয় তাঁহার ক্যামেরার বাক্স এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি লইয়া হাজির হইলেন। পূর্বদিনের ব্যবস্থা মত সদানন্দদাদাও উপস্থিত যথা সময়ে।
তাঁহারা উভয়ে বাড়ীর ছাদে যাইয়া উপযুক্ত স্থান নির্ণয় করিয়া ক্যামেরা বসাইলেন যাহাতে সূর্য্যরে প্রথম আলোতে ছবি তোলা সম্ভব হয়। ঠাকুর মহাশয় ছাদের উপর আসিলেন। সদানন্দদাদা পূর্ব ব্যবস্থামত একটি পিঁড়ির উপরে শাড়ী কাপড়ের পাড় দ্বারা নির্মিত একটি আসন পাতিয়া ঠাকুর মহাশয়কে বসিতে অনুরোধ করিলেন। মনমোহনদা কালো কাপড়ে নিজের মাথাটি সম্পূর্ণ ঢাকিয়া ছবি তোলার কাজে ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। সদানন্দদাদা মনমোহনদার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া অপেক্ষায় আছেন। পাইন মহাশয় ক্যামেরার মধ্যে দিয়া দেখিলেন ঠাকুর মহাশয় যেন বেশ মোটাসোটা অবস্থায় বসিয়া আছেন। মনমোহনদা সেই অবস্থায় একটি ছবি নিয়া পুনরায় আর একটি ছবি নিবার জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়া দেখিলেন এইবার ঠাকুর মহাশয়কে খুব রোগা মনে হইতেছে। আরও লক্ষ্য করিলেন ক্রমে উর্দ্ধনেত্র হইয়া শ্রীশ্রীঠাকুর যেন সমাধি মগ্ন। ঠাকুর মহাশয়কে ঐরূপ অবস্থায় দেখিয়া পার্শ্বে দ-ায়মান সদানন্দদাদাকে কনুইয়ের সাহায্যে স্পর্শ করিয়া ইশারায় ঠাকুরকে লক্ষ্য করিতে ইঙ্গিত করিলেন। তিনিও শ্রীশ্রীরামঠাকুরের সেই ধ্যান মগ্ন শ্রীমূর্ত্তি প্রত্যক্ষ করিলেন। মনমোহনদা শ্রীশ্রীরামঠাকুরের ঊর্দ্ধনেত্র ধ্যান মগ্ন রূপটি তাঁহার ক্যামেরায় ধরিয়া রাখিলেন।
সদানন্দদাদা জানাইলেন যে তিনি লক্ষ্য করিয়াছেন শ্রীযুক্ত মনমোহন পাইন মহাশয়ের বৈশিষ্ট্য ছিল, ছবি তোলা সময়ে ঠাকুরকে কোন প্রকার নির্দেশ তিনি দিতেন না। ঠাকুর মহাশয় যেমন বসিতেন তেমনভাবেই ছবি তুলিয়া লইতেন এবং স্টুডিওতে ছবি প্রস্তুত হইয়া গেলে সর্বাগ্রে শ্রীশ্রীঠাকুরকে তাহা না দেখাইয়া অন্য কাহাকেও তিনি সেই ছবি প্রথমে দেখাইতেন না।
কয়েকদিন পরে মনমোহনদা দুইখানা ছবি লইয়া শ্রীশ্রীঠাকুর দর্শনে আসিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া ঠাকুর মহাশয় বলিলেন, “কৈ দেখাইলেন নাতো কেমন ফটো হইছে।”
ঠাকুর মহাশয়ের শ্রীহস্তে তাঁহার তোলা ছবি দুইখানা দিলেন মনমোহনদা। প্রথম তোলা ছবিখানা দেখিয়া ঠাকুর মন্তব্য করিলেন, “এইটা একটু মোটা সোটা হইছে।”
পরের ছবিখানা দেখিয়া বলিলেন, “নির্ব্বংশীয়া ছবি হইছে।” ইহার অধিক সেই সময়ে ঠাকুর মহাশয় আর কিছুই বলিলেন না।
বস্তুত পক্ষে দ্বিতীয় বারে তোলা ঊর্দ্ধনেত্র ধ্যানস্থ ছবিখানা দেখিয়া তখনকার ভক্তদের ভাল লাগিয়াছিল। সকল আশ্রিত ভক্তদের দ্বারা নির্বাচিত হইয়াছিল বলিয়া ১৯৩০ সালে পাহাড়তলী শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম আশ্রম প্রতিষ্ঠা দিবসে শ্রীশ্রীরামঠাকুরের ঊর্দ্ধনেত্র ধ্যনমগ্ন ছবিটি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।
পরে তাহা স্থানান্তরিত হ্ইয়াছিল।
এক্ষণে শ্রদ্ধেয় মনমোহন পাইন মহাশয়ের অন্য আর একখানা ছবি তোলার বিবরণ দেওয়া হইতেছে।
চট্টগ্রাম পাহাড়তলীতে ১৯৩০ সালের কৈবল্যধাম আশ্রম প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্বে প্রতিবৎসর পূজার ছুটিতে পূর্ব্ব নির্দিষ্ট কোন স্থানে বাড়ীভাড়া করিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর সমভিব্যাহারে আশ্রিত ভক্তরা একসঙ্গে মিলিত হইতেন। তখন ঠাকুরের আশ্রিত ভক্তসংখ্যা এতই কম ছিল যে এখনকার তুলনায় তাহা ছিল খুব নগণ্য। দুই এর দশকের পূজার ছুটিতে এই রূপ অনুষ্ঠান প্রতিবৎসর নিয়মে পরিণত হইয়াছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্রদেবের সংস্পর্শে থাকিয়া দূর্গা পূজা উপলক্ষে ছুটির কয়েকটি দিন এমন সম্মেলনে যোগদানরত ভক্তদের দিনগুলি পরমানন্দে কাটিত। এই আনন্দ সম্মেলন কোন এক স্থানে নির্দিষ্ট ভাবে হইত না। ঢাকা, কলিকাতা, পুরী, দিল্লী, পাটনা, বেনারস ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হইত। এইরকম ব্যবস্থাই ঠাকুরের নির্দ্দেশ ছিল। দয়াল ঠাকুরের এইরূপ ব্যবস্থার অর্থ বুঝিতে কাহারও অসুবিধা হইত না। কারণ সকলের পক্ষে দূরবর্ত্তী কোন স্থানে সপরিবারে যোগ দেওয়া সম্ভব হইত না। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র আশ্রিতবর্গদের কথা ভাবিয়া ঠাকুরের এমন ব্যবস্থা। যেই বৎসর যেখানে এই আনন্দ সম্মেলন সংঘটিত হইত স্থানীয় সকল ভক্তরাও সপরিবারে যোগ দিতেন। পূজার ছুটির বহুপূর্বে স্থান নির্ণয় করিয়া স্থানীয় এবং বহিরাগত ভক্তদের জানান হইত। এইরূপ ভাবে ঠাকুর কর্তৃক নির্দ্দেশিত স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে সকলে মিলিত হইয়া শ্রীশ্রীঠাকুরকে লইয়া এমন আনন্দ উৎসবের আয়োজন করিতেন। এই কয়েকটি দিনে কোন কর্ম্মানুষ্ঠানই নির্দিষ্ট কিছু ছিল না। কখন ঠাকুরের কথা শ্রবণ করা, কখন ভাগবত পাঠ করা, কখন কীর্ত্তন আনন্দে মাতিয়া থাকা, কখন সকলে মিলিয়া সকাল সন্ধ্যায় ঠাকুর মহাশয়ের সহিত বেড়ান, আবার কেহ কেহ তাস, দাবা, লুডু ইত্যাদি খেলিয়া আনন্দ পাইতেন। সকলের আনন্দে শ্রীশ্রীঠাকুরও আনন্দ উপভোগ করিতেন। বিশেষ করিয়া সকলের খাওয়া দাওয়ার প্রতি ঠাকুর মহাশয়ের অধিক উৎসাহ দেখা যাইত। আহারাদি বিষয়ে তাঁহার কোন বিধি নিষেধ ছিল না। মাছ, মাংস, নিরামিষ সব রকমেরই ব্যবস্থা হইত। একটি বিষয়ে শ্রীশ্রীরামঠাকুরের বিশেষ নির্দ্দেশ ছিল যে, রান্না করার লোক রাখিতে হইবে। ঠাকুরের এই আদেশ অবশ্য পালনীয় ছিল। কারণ তাঁহার ভাষায়, “সারা বৎসর মায়েরা রান্নবান্নায় ব্যস্ত থাকেন, এ কয়টি দিন মায়েদের বিশ্রাম দিতে হইবে।”
আর ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে এক সঙ্গে আহার করিতে হইবে এইরূপ নির্দ্দেশও ঠাকুর মহাশয় দিয়াছিলেন আহারের সময় শ্রীশ্রীঠাকুর নিকটে এক স্থানে বসিয়া সকলের খাওয়া দাওয়া পর্য্যবেক্ষণ করিতেন। ঠাকুর মহাশয় নিজে প্রায় কিছুই গ্রহণ করিতেন না। যৎসামান্য আহার, তাঁহার নির্দিষ্ট সময়ে। কিন্তু অন্য সকলে আহার করিয়া তৃপ্তি পাইলে মনে হইত ঠাকুরও খুব তৃপ্তি বোধ করিতেছেন।
ঐরূপ একবার ১৯২৯ সালে পূজার ছুটিতে ঢাকা শহরের অনতিদূরে একজন পুলিশ অফিসারের একটি খালি বাড়ী একমাসের জন্য ভাড়া করা হইয়াছিল। সদানন্দ চক্রবর্ত্তী তখন ঢাকা জগন্নাথ কলেজে পড়িতেছিলেন। সেই বৎসর পূজার ছুটিতে এই আনন্দ মিলনে সকলের সঙ্গে সদানন্দদা সর্ব্বপ্রথম যোগদান করিয়াছিলেন। বস্তুত পক্ষে উহাই ছিল ঐরূপ আনন্দানুষ্ঠানের সর্বশেষ অনুষ্ঠান। কারণ পরের বৎসর ১৯৩০ সালের জুলাই মাসে শ্রীশ্রীকৈবল্যধাম আশ্রম প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে আশ্রমের দুর্গোৎসবেই সকল ভক্তবৃন্দ যোগদান করিতে লাগিলেন। সে যাহা হউক, ১৯২৯ সালে পূজার ছুটিতে ঢাকায়, সেই আনন্দ-সম্মিলনে স্থানীয় অনেক ভক্তদের মধ্যে শ্রীযুক্ত মনমোহন পাইন মহাশয় সপরিবারে যোগদান করিয়াছিলেন। সদানন্দদাদা এবং মনমোহনদাদা উভয়েই সব সময় প্রায় এক সঙ্গেই থাকিতেন। এই আনন্দানুষ্ঠানে মনমোহনদাদা ঠাকুরের নিকট একখানা ছবি তোলার প্রার্থনা করিলে তাহা ঠাকুর মহাশয় কর্তৃক সহজেই অনুমোদিত হইল। সূর্য্যালোকে খোলামেলা একটি স্থানে শ্রীশ্রীঠাকুর আসিয়া বসিলেন। একটি আসন পূর্বেই পাতিয়া রাখা হইয়াছিল। শাড়ী কাপড়ের পাড়া দ্বারা নির্ম্মিত আসন ছিল না কি তাহা কম্বল ভাঁজ করিয়া পাতা হইয়াছিল, বহুদিন আগেকার কথা সদানন্দদাদা তাহা স্মরণ করিতে পারিলেন না।
ঠাকুর মহাশয় পরিহিত বস্ত্রে যে অবস্থায় ছিলেন তেমনই আসিয়া আসনে বসিলেন। কেবলমাত্র একখানা সাদা চাদরে সর্ব্বাঙ্গ ঢাকিয়া নিলেন। আসনে বসিয়া অনুমতি দিলেন মনমোহনদাকে ছবি তুলিবার জন্য। অনুমতি পাইয়া আসনে উপবিষ্ট ঠাকুর মহাশয়ের পিছন দিকে একখানা বড় চাদর টানিয়া ধরিতে দুইজনকে বলিয়া মনমোহনদা ছবি তোলার যন্ত্রের উপর নিজেকে কালো কাপড় ঢাকিয়া একখানা ছবি ক্যামেরায় তুলিয়া লইলেন।
ইহার কিছুদিন পরে মনমোহনদা সদানন্দকে জানাইলেন যে, স্টুডিওতে ছবির কাজ শেষ হওয়ার পরে দেখিলেন ছবিতে ঠাকুরের গায়ের চাদরের কিয়দংশ জড় হইয়া আছে উপবিষ্ট ঠাকুর মহাশয়ের বাম পার্শ্বে এবং পশ্চাৎভাগে যাঁহারা পর্দা ধরায় ব্যস্ত ছিলেন তাহাদের একজনের পশ্চাৎদ্দেশ ছবিতে দৃষ্ট হইতেছে। ফটোতে এমন অবাঞ্চিত বস্ত্রগুলি দেখিয়া মনমোহনদা খুবই অনুতপ্ত হইয়াছিলেন। কি করিবেন প্রথমে স্থির করিতেই কয়েকদিন কাটিয়া গেল। শ্রীশ্রীঠাকুরের ছবিতে ছুড়ি কাঁচি চালাইতে তাঁহার মন চাহিতেছিল না।
এদিকে কয়েকদিন পরে ঠাকুর মহাশয়ের সহিত মনমোহনদার সাক্ষাৎ হইতেই তিনি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ফটো কেমন হইছে দেখাইবেন নাঃ” এই কথার পরে মনমোহনদা সেই অবস্থাতেই ঠাকুরকে ছবিখানা দেখাইতে বাধ্য হইলেন। কিন্তু ক্রুটি বিচ্যুতির দিকে লক্ষ না করিয়া ঠাকুর ছবিখানা দেখিয়াই উক্তি করিলেন,-“হ, গুরু কইলেন, ‘রাম, তোর এই ফটোখানাই ঠিক হইছে।” ঠাকুর স্বগতোক্তির ন্যায় কহিলেন, “ইনিই কৈবল্যনাথ।”
“কৈবল্যনাথ”? বলিয়া মনমোহন পাইন মহাশয় ঠাকুরের দিকে চাহিয়া থাকিলে ঠাকুর পুনরায় বলিলেন, “ঐ দেশে এই নামই আছিল।” বলিয়াই ঠাকুর চুপ করিয়া গেলেন। মনমোহনদাও আর কোন প্রশ্ন করিলেন না।
শ্রীশ্রীরামঠাকুরের এমন উক্তিতে অনুপ্রাণিত হইয়া মনমোহনদা দ্বিগুণ উৎসাহে তাঁহার স্টুডিওতে বহু চেষ্টার পরে ঠাকুরের ছবির পিছনে জনৈক ব্যক্তির দেহাংশ বাদ দিতে সমর্থ হইলেন এবং ঠাকুরের বাম পার্শ্বে স্তপীকৃত বস্ত্রের অধিকাংশ মুছিয়া ফেলিলেও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করিতে পারেন নাই। জড় হইয়া থাকা চাদরের সামান্য কিছু অংশ থাকিয়া যায়। কারণ তাহা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করিতে গেলে ঠাকুরের শ্রীচরণ যথাযথ রাখা সম্ভব হইতেছিল না। এই পরিপ্রেক্ষিতে সদানন্দদাদা যাঁহা বলিলেন, “কালক্রমে বহুবার নেগেটিভ এবং ব্লক করিতে হইয়াছে। তাহাতে স্তূপীকৃত বস্ত্রের অবশিষ্টাংশ, যাহা শ্রীযুক্ত মনমোহনদা নিশ্চিহ্ন করিতে সমর্থ হন নাই, তাহা বর্ত্তমানে ক্ষুদ্রাকারে রূপান্তরিত হয়। দেখিতে অনেকটা ফুলের মতই মনে হয়। ইহা লইয়া এক সময় গুজব রটনা হয় যে ঠাকুরের শ্রীপদে পদ্মফুল প্রস্ফুটিত হইয়াছে। বাস্তবিক পক্ষে তাহা ঠিক নহে। সবটাই গুজব।”
এই হইল শ্রীশ্রীকৈবল্যনাথ-পট নির্ম্মাণের ইতিহাস।জয় রাম,
‘শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথ’ -পট নির্মাণের ইতিহাস,,
শ্রীশ্রীরামঠাকুরের আশ্রিত পরমভক্ত শ্রীযুক্ত মনমোহন পাইন মহাশয়। পেশায় তিনি ছিলেন একজন ফটোগ্রাফার। ঢাকা শহরে তাঁহার ছোট একটি দোকান ছিল। ফটোতোলার কাজ করিয়া পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা কোন প্রকারে অতি দরিদ্রতার সহিত নির্ব্বাহ হইত। শ্রীশ্রীরামঠাকুরের প্রতি ছিল তাঁহার অগাধ বিশ্বাস এবং ভক্তি। কোনরূপ উচ্চাকাঙ্খা বা প্রার্থনা ছিল না তাঁহার। শ্রীশ্রীরামঠাকুরের প্রতি মনমোহনদার গভীর অনুরাগ সদানন্দবাবুকে আকর্ষণ করিয়াছিল সহজেই। অন্যদিকে এত অল্প সময়ে গুরুর প্রতি সদানন্দের প্রগাঢ় ভক্তি শ্রদ্ধা, আকৃষ্ট করিয়াছিল ফটোগ্রাফার মনমোহনদাকে। স্নেহ ভালবাসার জোরে একে অন্যকে আপন করিয়া লইয়াছিলেন। বয়সের পার্থক্য বাধা হয় নাই। কখনও মনমোহনদার সংস্পর্শে আসিলে সদানন্দদাদা তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে থাকিতেই আনন্দ বোধ করিতেন।
মনমোহনদার প্রাণের ইচ্ছা শ্রীশ্রীরামঠাকুরের কয়েকটি ছবি তোলেন। কিন্তু স্বল্পভাষী লাজুক প্রকৃতির মানুষ, মনমোহনদা ঠাকুর মহাশয়কে বলিতে সাহস পাইতেছিলেন না। তাঁহার অন্তরের ওই ইচ্ছার কথা সদানন্দদাদাকেও বলিলেন। অবশেষে তাঁহার আন্তরিক বাসনা শ্রীশ্রীঠাকুর পূর্ণ করিলেন। ঢাকা শহরের গেন্ডারিয়াতে কোন এক ভক্তগৃহে শ্রীশ্রীরামঠাকুরের শুভাগমন হইল। সদানন্দদাদাকে সঙ্গে লইয়া মনমোহনদা অতিশয় কাতর হইয়া করজোড়ে ঠাকুর মহাশয়ের নিকট ছবি তোলার প্রার্থনা করিলেন। ঠাকুর মহাশয় পরের দিন তাঁহাকে আসিতে বলিলেন।
ছবি তোলার যন্ত্রপাতি বর্ত্তমানের ন্যায়, সেই সময়ে এত উন্নত ছিলনা। তাহা ছাড়া তখনকার অপেক্ষাকৃত উন্নত কারিগরির যন্ত্রাদি সংগ্রহ করা দরিদ্র মনমোহন পাইন মহাশয়ের সামর্থ্য তেমন ছিল না। তিন পায়া বিশিষ্ট একটি বস্তুর উপর ছবি তোলা বাক্সটি রাখিয়া ছবি তোলার কাজ সারিতেন তিনি। পরের দিন প্রত্যূষে পাইন মহাশয় তাঁহার ক্যামেরার বাক্স এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি লইয়া হাজির হইলেন। পূর্বদিনের ব্যবস্থা মত সদানন্দদাদাও উপস্থিত যথা সময়ে।
তাঁহারা উভয়ে বাড়ীর ছাদে যাইয়া উপযুক্ত স্থান নির্ণয় করিয়া ক্যামেরা বসাইলেন যাহাতে সূর্য্যরে প্রথম আলোতে ছবি তোলা সম্ভব হয়। ঠাকুর মহাশয় ছাদের উপর আসিলেন। সদানন্দদাদা পূর্ব ব্যবস্থামত একটি পিঁড়ির উপরে শাড়ী কাপড়ের পাড় দ্বারা নির্মিত একটি আসন পাতিয়া ঠাকুর মহাশয়কে বসিতে অনুরোধ করিলেন। মনমোহনদা কালো কাপড়ে নিজের মাথাটি সম্পূর্ণ ঢাকিয়া ছবি তোলার কাজে ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। সদানন্দদাদা মনমোহনদার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া অপেক্ষায় আছেন। পাইন মহাশয় ক্যামেরার মধ্যে দিয়া দেখিলেন ঠাকুর মহাশয় যেন বেশ মোটাসোটা অবস্থায় বসিয়া আছেন। মনমোহনদা সেই অবস্থায় একটি ছবি নিয়া পুনরায় আর একটি ছবি নিবার জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়া দেখিলেন এইবার ঠাকুর মহাশয়কে খুব রোগা মনে হইতেছে। আরও লক্ষ্য করিলেন ক্রমে উর্দ্ধনেত্র হইয়া শ্রীশ্রীঠাকুর যেন সমাধি মগ্ন। ঠাকুর মহাশয়কে ঐরূপ অবস্থায় দেখিয়া পার্শ্বে দ-ায়মান সদানন্দদাদাকে কনুইয়ের সাহায্যে স্পর্শ করিয়া ইশারায় ঠাকুরকে লক্ষ্য করিতে ইঙ্গিত করিলেন। তিনিও শ্রীশ্রীরামঠাকুরের সেই ধ্যান মগ্ন শ্রীমূর্ত্তি প্রত্যক্ষ করিলেন। মনমোহনদা শ্রীশ্রীরামঠাকুরের ঊর্দ্ধনেত্র ধ্যান মগ্ন রূপটি তাঁহার ক্যামেরায় ধরিয়া রাখিলেন।
সদানন্দদাদা জানাইলেন যে তিনি লক্ষ্য করিয়াছেন শ্রীযুক্ত মনমোহন পাইন মহাশয়ের বৈশিষ্ট্য ছিল, ছবি তোলা সময়ে ঠাকুরকে কোন প্রকার নির্দেশ তিনি দিতেন না। ঠাকুর মহাশয় যেমন বসিতেন তেমনভাবেই ছবি তুলিয়া লইতেন এবং স্টুডিওতে ছবি প্রস্তুত হইয়া গেলে সর্বাগ্রে শ্রীশ্রীঠাকুরকে তাহা না দেখাইয়া অন্য কাহাকেও তিনি সেই ছবি প্রথমে দেখাইতেন না।
কয়েকদিন পরে মনমোহনদা দুইখানা ছবি লইয়া শ্রীশ্রীঠাকুর দর্শনে আসিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া ঠাকুর মহাশয় বলিলেন, “কৈ দেখাইলেন নাতো কেমন ফটো হইছে।”
ঠাকুর মহাশয়ের শ্রীহস্তে তাঁহার তোলা ছবি দুইখানা দিলেন মনমোহনদা। প্রথম তোলা ছবিখানা দেখিয়া ঠাকুর মন্তব্য করিলেন, “এইটা একটু মোটা সোটা হইছে।”
পরের ছবিখানা দেখিয়া বলিলেন, “নির্ব্বংশীয়া ছবি হইছে।” ইহার অধিক সেই সময়ে ঠাকুর মহাশয় আর কিছুই বলিলেন না।
বস্তুত পক্ষে দ্বিতীয় বারে তোলা ঊর্দ্ধনেত্র ধ্যানস্থ ছবিখানা দেখিয়া তখনকার ভক্তদের ভাল লাগিয়াছিল। সকল আশ্রিত ভক্তদের দ্বারা নির্বাচিত হইয়াছিল বলিয়া ১৯৩০ সালে পাহাড়তলী শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম আশ্রম প্রতিষ্ঠা দিবসে শ্রীশ্রীরামঠাকুরের ঊর্দ্ধনেত্র ধ্যনমগ্ন ছবিটি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।
পরে তাহা স্থানান্তরিত হ্ইয়াছিল।
এক্ষণে শ্রদ্ধেয় মনমোহন পাইন মহাশয়ের অন্য আর একখানা ছবি তোলার বিবরণ দেওয়া হইতেছে।
চট্টগ্রাম পাহাড়তলীতে ১৯৩০ সালের কৈবল্যধাম আশ্রম প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্বে প্রতিবৎসর পূজার ছুটিতে পূর্ব্ব নির্দিষ্ট কোন স্থানে বাড়ীভাড়া করিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর সমভিব্যাহারে আশ্রিত ভক্তরা একসঙ্গে মিলিত হইতেন। তখন ঠাকুরের আশ্রিত ভক্তসংখ্যা এতই কম ছিল যে এখনকার তুলনায় তাহা ছিল খুব নগণ্য। দুই এর দশকের পূজার ছুটিতে এই রূপ অনুষ্ঠান প্রতিবৎসর নিয়মে পরিণত হইয়াছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্রদেবের সংস্পর্শে থাকিয়া দূর্গা পূজা উপলক্ষে ছুটির কয়েকটি দিন এমন সম্মেলনে যোগদানরত ভক্তদের দিনগুলি পরমানন্দে কাটিত। এই আনন্দ সম্মেলন কোন এক স্থানে নির্দিষ্ট ভাবে হইত না। ঢাকা, কলিকাতা, পুরী, দিল্লী, পাটনা, বেনারস ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হইত। এইরকম ব্যবস্থাই ঠাকুরের নির্দ্দেশ ছিল। দয়াল ঠাকুরের এইরূপ ব্যবস্থার অর্থ বুঝিতে কাহারও অসুবিধা হইত না। কারণ সকলের পক্ষে দূরবর্ত্তী কোন স্থানে সপরিবারে যোগ দেওয়া সম্ভব হইত না। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র আশ্রিতবর্গদের কথা ভাবিয়া ঠাকুরের এমন ব্যবস্থা। যেই বৎসর যেখানে এই আনন্দ সম্মেলন সংঘটিত হইত স্থানীয় সকল ভক্তরাও সপরিবারে যোগ দিতেন। পূজার ছুটির বহুপূর্বে স্থান নির্ণয় করিয়া স্থানীয় এবং বহিরাগত ভক্তদের জানান হইত। এইরূপ ভাবে ঠাকুর কর্তৃক নির্দ্দেশিত স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে সকলে মিলিত হইয়া শ্রীশ্রীঠাকুরকে লইয়া এমন আনন্দ উৎসবের আয়োজন করিতেন। এই কয়েকটি দিনে কোন কর্ম্মানুষ্ঠানই নির্দিষ্ট কিছু ছিল না। কখন ঠাকুরের কথা শ্রবণ করা, কখন ভাগবত পাঠ করা, কখন কীর্ত্তন আনন্দে মাতিয়া থাকা, কখন সকলে মিলিয়া সকাল সন্ধ্যায় ঠাকুর মহাশয়ের সহিত বেড়ান, আবার কেহ কেহ তাস, দাবা, লুডু ইত্যাদি খেলিয়া আনন্দ পাইতেন। সকলের আনন্দে শ্রীশ্রীঠাকুরও আনন্দ উপভোগ করিতেন। বিশেষ করিয়া সকলের খাওয়া দাওয়ার প্রতি ঠাকুর মহাশয়ের অধিক উৎসাহ দেখা যাইত। আহারাদি বিষয়ে তাঁহার কোন বিধি নিষেধ ছিল না। মাছ, মাংস, নিরামিষ সব রকমেরই ব্যবস্থা হইত। একটি বিষয়ে শ্রীশ্রীরামঠাকুরের বিশেষ নির্দ্দেশ ছিল যে, রান্না করার লোক রাখিতে হইবে। ঠাকুরের এই আদেশ অবশ্য পালনীয় ছিল। কারণ তাঁহার ভাষায়, “সারা বৎসর মায়েরা রান্নবান্নায় ব্যস্ত থাকেন, এ কয়টি দিন মায়েদের বিশ্রাম দিতে হইবে।”
আর ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে এক সঙ্গে আহার করিতে হইবে এইরূপ নির্দ্দেশও ঠাকুর মহাশয় দিয়াছিলেন আহারের সময় শ্রীশ্রীঠাকুর নিকটে এক স্থানে বসিয়া সকলের খাওয়া দাওয়া পর্য্যবেক্ষণ করিতেন। ঠাকুর মহাশয় নিজে প্রায় কিছুই গ্রহণ করিতেন না। যৎসামান্য আহার, তাঁহার নির্দিষ্ট সময়ে। কিন্তু অন্য সকলে আহার করিয়া তৃপ্তি পাইলে মনে হইত ঠাকুরও খুব তৃপ্তি বোধ করিতেছেন।
ঐরূপ একবার ১৯২৯ সালে পূজার ছুটিতে ঢাকা শহরের অনতিদূরে একজন পুলিশ অফিসারের একটি খালি বাড়ী একমাসের জন্য ভাড়া করা হইয়াছিল। সদানন্দ চক্রবর্ত্তী তখন ঢাকা জগন্নাথ কলেজে পড়িতেছিলেন। সেই বৎসর পূজার ছুটিতে এই আনন্দ মিলনে সকলের সঙ্গে সদানন্দদা সর্ব্বপ্রথম যোগদান করিয়াছিলেন। বস্তুত পক্ষে উহাই ছিল ঐরূপ আনন্দানুষ্ঠানের সর্বশেষ অনুষ্ঠান। কারণ পরের বৎসর ১৯৩০ সালের জুলাই মাসে শ্রীশ্রীকৈবল্যধাম আশ্রম প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে আশ্রমের দুর্গোৎসবেই সকল ভক্তবৃন্দ যোগদান করিতে লাগিলেন। সে যাহা হউক, ১৯২৯ সালে পূজার ছুটিতে ঢাকায়, সেই আনন্দ-সম্মিলনে স্থানীয় অনেক ভক্তদের মধ্যে শ্রীযুক্ত মনমোহন পাইন মহাশয় সপরিবারে যোগদান করিয়াছিলেন। সদানন্দদাদা এবং মনমোহনদাদা উভয়েই সব সময় প্রায় এক সঙ্গেই থাকিতেন। এই আনন্দানুষ্ঠানে মনমোহনদাদা ঠাকুরের নিকট একখানা ছবি তোলার প্রার্থনা করিলে তাহা ঠাকুর মহাশয় কর্তৃক সহজেই অনুমোদিত হইল। সূর্য্যালোকে খোলামেলা একটি স্থানে শ্রীশ্রীঠাকুর আসিয়া বসিলেন। একটি আসন পূর্বেই পাতিয়া রাখা হইয়াছিল। শাড়ী কাপড়ের পাড়া দ্বারা নির্ম্মিত আসন ছিল না কি তাহা কম্বল ভাঁজ করিয়া পাতা হইয়াছিল, বহুদিন আগেকার কথা সদানন্দদাদা তাহা স্মরণ করিতে পারিলেন না।
ঠাকুর মহাশয় পরিহিত বস্ত্রে যে অবস্থায় ছিলেন তেমনই আসিয়া আসনে বসিলেন। কেবলমাত্র একখানা সাদা চাদরে সর্ব্বাঙ্গ ঢাকিয়া নিলেন। আসনে বসিয়া অনুমতি দিলেন মনমোহনদাকে ছবি তুলিবার জন্য। অনুমতি পাইয়া আসনে উপবিষ্ট ঠাকুর মহাশয়ের পিছন দিকে একখানা বড় চাদর টানিয়া ধরিতে দুইজনকে বলিয়া মনমোহনদা ছবি তোলার যন্ত্রের উপর নিজেকে কালো কাপড় ঢাকিয়া একখানা ছবি ক্যামেরায় তুলিয়া লইলেন।
ইহার কিছুদিন পরে মনমোহনদা সদানন্দকে জানাইলেন যে, স্টুডিওতে ছবির কাজ শেষ হওয়ার পরে দেখিলেন ছবিতে ঠাকুরের গায়ের চাদরের কিয়দংশ জড় হইয়া আছে উপবিষ্ট ঠাকুর মহাশয়ের বাম পার্শ্বে এবং পশ্চাৎভাগে যাঁহারা পর্দা ধরায় ব্যস্ত ছিলেন তাহাদের একজনের পশ্চাৎদ্দেশ ছবিতে দৃষ্ট হইতেছে। ফটোতে এমন অবাঞ্চিত বস্ত্রগুলি দেখিয়া মনমোহনদা খুবই অনুতপ্ত হইয়াছিলেন। কি করিবেন প্রথমে স্থির করিতেই কয়েকদিন কাটিয়া গেল। শ্রীশ্রীঠাকুরের ছবিতে ছুড়ি কাঁচি চালাইতে তাঁহার মন চাহিতেছিল না।
এদিকে কয়েকদিন পরে ঠাকুর মহাশয়ের সহিত মনমোহনদার সাক্ষাৎ হইতেই তিনি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ফটো কেমন হইছে দেখাইবেন নাঃ” এই কথার পরে মনমোহনদা সেই অবস্থাতেই ঠাকুরকে ছবিখানা দেখাইতে বাধ্য হইলেন। কিন্তু ক্রুটি বিচ্যুতির দিকে লক্ষ না করিয়া ঠাকুর ছবিখানা দেখিয়াই উক্তি করিলেন,-“হ, গুরু কইলেন, ‘রাম, তোর এই ফটোখানাই ঠিক হইছে।” ঠাকুর স্বগতোক্তির ন্যায় কহিলেন, “ইনিই কৈবল্যনাথ।”
“কৈবল্যনাথ”? বলিয়া মনমোহন পাইন মহাশয় ঠাকুরের দিকে চাহিয়া থাকিলে ঠাকুর পুনরায় বলিলেন, “ঐ দেশে এই নামই আছিল।” বলিয়াই ঠাকুর চুপ করিয়া গেলেন। মনমোহনদাও আর কোন প্রশ্ন করিলেন না।
শ্রীশ্রীরামঠাকুরের এমন উক্তিতে অনুপ্রাণিত হইয়া মনমোহনদা দ্বিগুণ উৎসাহে তাঁহার স্টুডিওতে বহু চেষ্টার পরে ঠাকুরের ছবির পিছনে জনৈক ব্যক্তির দেহাংশ বাদ দিতে সমর্থ হইলেন এবং ঠাকুরের বাম পার্শ্বে স্তপীকৃত বস্ত্রের অধিকাংশ মুছিয়া ফেলিলেও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করিতে পারেন নাই। জড় হইয়া থাকা চাদরের সামান্য কিছু অংশ থাকিয়া যায়। কারণ তাহা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করিতে গেলে ঠাকুরের শ্রীচরণ যথাযথ রাখা সম্ভব হইতেছিল না। এই পরিপ্রেক্ষিতে সদানন্দদাদা যাঁহা বলিলেন, “কালক্রমে বহুবার নেগেটিভ এবং ব্লক করিতে হইয়াছে। তাহাতে স্তূপীকৃত বস্ত্রের অবশিষ্টাংশ, যাহা শ্রীযুক্ত মনমোহনদা নিশ্চিহ্ন করিতে সমর্থ হন নাই, তাহা বর্ত্তমানে ক্ষুদ্রাকারে রূপান্তরিত হয়। দেখিতে অনেকটা ফুলের মতই মনে হয়। ইহা লইয়া এক সময় গুজব রটনা হয় যে ঠাকুরের শ্রীপদে পদ্মফুল প্রস্ফুটিত হইয়াছে। বাস্তবিক পক্ষে তাহা ঠিক নহে। সবটাই গুজব।”
এই হইল শ্রীশ্রীকৈবল্যনাথ-পট নির্ম্মাণের ইতিহাস।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

🦁 সিংহ ও ইঁদুর 🐭 ঠাকুরমার ঝুলি থেকে নীতিশিক্ষামূলক গল্প

  🦁 সিংহ ও ইঁদুর 🐭 ঠাকুরমার ঝুলি থেকে নীতিশিক্ষামূলক গল্প   একদা এক গভীর জঙ্গলে এক বিশাল সিংহ বাস করত। সে ছিল বনের রাজা, সমস্ত প্রাণী তার ভয়ে কাঁপত। একদিন দুপুরবেলা রাজা সিংহ খেয়ে দেয়ে এক গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ল। এমন সময়, এক ছোট্ট ইঁদুর তার গর্ত থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছিল। খেলার ছলেই সে ভুলবশত সিংহের গায়ের উপর চড়ে গেল। এতে সিংহের ঘুম ভেঙে গেল। 😡 ⚡ গর্জন করে সে ইঁদুরটিকে ধরে ফেলল এবং রাগান্বিত স্বরে বলল, 👉 "দুষ্ট ইঁদুর! তুমি এত সাহসী হলে যে আমায় বিরক্ত করছ? এখন আমি তোমাকে খেয়ে ফেলব!" ইঁদুরটি ভয়ে কাঁপতে লাগল এবং হাতজোড় করে বলল, 🙏 "মহারাজ, দয়া করুন! আমি খুবই ছোট্ট আর অসহায়। দয়া করে আমাকে মুক্ত করুন। আমি একদিন আপনার উপকারে আসব!" সিংহ হেসে বলল, 😆 "তুমি এত ছোট একটা প্রাণী! তুমি আবার কীভাবে আমার উপকার করবে?" তবুও, সিংহ দয়ালু হয়ে ইঁদুরটিকে মুক্ত করে দিল । ইঁদুর আনন্দে লাফিয়ে গিয়ে বলল, 🐭 "আপনার এই দয়ার প্রতিদান আমি একদিন দেব, মহারাজ!" ⏳ কিছুদিন পর... সিংহ একদিন বনের মধ্যে শিকারের সন্ধানে ঘুরছিল। হঠাৎ সে এক শিকার...

"বাঘ এসেছিল!|শিশুদের জন্য একটি রহস্যময় বাংলা গল্পIThere Comes the Tiger...

✋ হাতের রেখা বিচার A থেকে Z (Palmistry in Bengali)

    ✋ হাতের রেখা বিচার A থেকে Z (Palmistry in Bengali) 🔠 A থেকে Z বিষয়ভিত্তিক তালিকা: অক্ষর বিষয় বাংলা ব্যাখ্যা A Arjuna Line বিজয়ের রেখা, সাফল্যের প্রতীক B Bracelet Lines কব্জির দাগ, আয়ু ও ভাগ্যের সংকেত C Cross on Palm হাতের ক্রস চিহ্ন – বাধা বা আশীর্বাদ D Destiny Line (ভাগ্যরেখা) কর্মজীবন ও ভাগ্যের দিক নির্ধারণ E Education Line শিক্ষাগত সাফল্যের রেখা F Fate Line কর্মজীবনের উত্থানপতনের রেখা G Girdle of Venus অতিরিক্ত আবেগ বা শিল্পপ্রতিভার চিহ্ন H Heart Line (হৃদয়রেখা) ভালোবাসা ও সম্পর্কের সূচক I Island Sign জীবনে বাধা বা কষ্টের প্রতীক J Jupiter Mount নেতৃত্ব, সম্মান ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা K Ketu Line আধ্যাত্মিকতা ও বিচ্ছিন্নতার রেখা L Life Line (জীবনরেখা) শরীর, স্বাস্থ্য ও আয়ুর ইঙ্গিত M Mystic Cross আধ্যাত্মিক প্রতিভার চিহ্ন N Nail Shape স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে O Om Symbol on Palm আধ্যাত্মিক শক্তির ইঙ্গিত P Palm Shape চার প্রকার – Earth, Air, Fire, Water Palm Q Quadrangle (রেখার ম...